Tuesday 19 May 2020

১৯শে মে এবং বর্তমান বরাক উপত‍্যকা | দুয়েক কথা

 পশ্চিমবঙ্গে বরাকের বাংলা ভাষা আন্দোলন নিয়ে দু কথা লেখা খুঁজে পাওয়া বেশ শ্রমসাধ‍্য। একুশে ফেব্রুয়ারির সামনে ত বরাকের রক্ত ফিকে পড়ে যায়! কত দেখলাম।

অবশ‍্য, বরাকবাসীরা নিজেরাই এর ব‍্যতিক্রম কিসে?
শুধু রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করার বেলা বিশেষ উদ্দেশ্যে হিন্দি ভাষার বিরোধ করার বেলা এদের এই দিনটিকে মনে পড়ে। আর সেই একই দুষ্ট উদ্দেশ্যে এই বরাকেই লাচিত দিবস পালন করতে অসুবিধা হয় না, "জয় 'আই' অসম' স্লোগান দিতে লজ্জা করে না সেই  অসমীয়াদেরকেই তুষ্ট করতে, যারা আমাদের বাংলা মায়ের টুঁটি টিপে ধরেছিল, পিষে মেরে ফেলেছিল বাংলা মায়ের সন্তানদের তাদের মুখ থেকে মা ডাক মুছে ফেলার জন্যে, কন্ঠরোধ করে দেবার জন্যে ১৯৬১ সালেই নয় শুধু, এর অনেক আগের থেকেই এই ভাষাবিভেদ ও আঞ্চলিকতার বিষবৃক্ষের শিকড় ছড়িয়ে পড়েছিল শুধু বরাক উপত‍্যকাতেই নয়, সমগ্র আসামে। গোয়ালপাড়া সহ আরও বিভিন্ন হিন্দু বাঙালি অধ‍্যুষিত অঞ্চল থেকে হিন্দু বাঙালিদের  অত‍্যাচার, হত্যা, বসতবাটীতে অগ্নিসংযোগ করার মাধ্যমে বলপূর্বক বিতাড়ন করা হয়, তাও রীতিমতো সরকারি নির্দেশে!


আর এই অসমীয়াদের সুখতলাই চাটছে বরাকের বর্তমান বুদ্ধিজীবী বাঙালিরা। অসমীয়া ভাষা পাঠ‍্যক্রমে বাধ্যতামূলক হলে তখন আর তাদের "উনিশে মে" মনে পড়ে না। শুধুমাত্র হিন্দির প্রসঙ্গ এলেই তাদের গায়ে ধুম জ্বর আসে। তবে, বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার আসাম চুক্তির অনুচ্ছেদ ৬ কে বলবৎ করার যে ইঙ্গিত দিচ্ছে তাতে, ১৯৬১ সালের পরিস্থিতি প্রত‍্যাবর্তনের সমূহ সম্ভাবনা। বরং বর্তমানে পরিস্থিতি হবে আরও ভয়াবহ। কারণ, আসামের 'বঙালী খেদাও' এর নায়করা মূলতঃ হিন্দু বাঙালি খেদাও এর নায়ক, এবং সেটা আসামের যে কোন রাজনৈতিক দল নির্বিশেষে।
সম্প্রতি এক উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক ব‍্যক্তিত্বের মুখের কথা শুনেছিলাম যাঁর বক্তব্য ছিল নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন CAA প্রসঙ্গে এইরূপ, যে আসামে ৪০০০০০০ বিশেষ সম্প্রদায় (যাদের মূল অংশই অবৈধ অনুপ্রবেশকারী) তাদেরকে সহ‍্য করতে রাজী কিন্তু, মাত্র ৫০০০০০ হিন্দু শরণার্থীদের নয়। ভোটের রাজনীতি কত ঘৃণ্য! পরে যদিও তিনি সুর পাল্টান, তবে সুর আর দল বদলেও ভিতরের উদ্দেশ্য কিন্তু বদলায় না। আর আজকের দিনে দাঁড়িয়ে ১৯৬১ সালের ভাষা আন্দোলন এর সাথে বর্তমান CAA, ৬ নং অনুচ্ছেদ, ও বরাকের নীচমনা বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের নপুংসকতা ও চক্রান্ত কিন্তু ভীষণভাবে পরস্পর সম্পর্কিত। কারণ, আসাম তথা বরাকে বাংলাবিরোধী যে বিষধোঁয়া আবার কুন্ডলি খুলে ফণা তুলতে চাইছে, তাতে আসামীদের সঙ্গে এবার হাত মেলাবে বরাকের সেই  বাঙালিরা যারা, অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের বিরুদ্ধে আইন আনলে, সরকারকে মুসলিম বিরোধী বলে মিথ্যা প্রচারণা ও বিশ্বাস করে। যারা রত্নগর্ভা ভারত ও বাংলা মায়ের কোন মহান  যোগ্য সন্তানের জীবনী জীবনেও পড়েনা বা পড়লেও অনুপ্রাণিত হয় না। পাকিস্তানের কোন নামকরা ব‍্যক্তি তাদের কাছে আদর্শ। 


উনিশে মে র কোন মূল্য  নেই  তাদের কাছে, কারণ, তাদের বাঙালি মা বাবার কাছেই বাংলার মূল্য নেই। যে দেশে জন্মায়, বাঁচে, যে ভাষায় মুখের প্রথম বুলি ফোটে, সেই দেশ হোক বা ভাষার সম্মান কেন আদরটুকুও নেই। এরা হিংসা ও আক্রোশে এত অন্ধ। ভারতমাতার বুকের রক্ত খেয়ে পরিপুষ্ট আর বাংলা মায়ের নরম কোলো নিশ্চিতে শুয়ে পাকিস্তানের প্রতি গভীর টান আর আরবের প্রতি উন্মাদ আকর্ষণ বোধ করে।

এরা তাই বাঙালী  হয়েও বাংলাকে কেন ভালবাসবে? এরা বাঙালী হয়েও বাংলা নাম রাখেনা সন্তানদের। দেশ-ভাষা-মা ডাক এর আগে এদের কাছে স্হান পায় ধর্মান্ধতা। আরবি মিশ্রিত ভাষাই এদের সত্যিকারের মাতৃভাষা।

এরা রবীন্দ্রনাথ, সুকান্ত জানে বোঝে না। নজরুলের নামটুকুও নেয় শুধুমাত্র ধর্মের আবেশে। তারা আসল নজরুলকে জানার চেষ্টাও করেনা। 


আর বরাকের বাংলা আন্দোলন ও ভাষাশহীদের কি সম্মান করবে আর ভালবাসবে, তাদের মর্ম বুঝবে আর সন্তানের বোঝাবে?
তারা আরব চেনে এত শিক্ষিত কিন্তু, ১৯ শে মে বোঝে না, এত মর্মান্তিকভাবে নিঃস্ব, হৃদয় ও মস্তিষ্কে। 
তাদের সন্তানরা সরকারের বিরোধী কথা বলতে জানে দেশদ্রোহীদের সমর্থনে গলা ফাটিয়ে দেশের প্রধানমন্ত্রীকে অশ্লীল অভদ্র ভাষায় গালি দিয়ে নিজেকে রাজনীতিবিদ ভেবে অহংকারের ঘোরে পাগল হয়ে মরে, কিন্তু, এক পঙ্ক্তি বাংলা শুদ্ধ করে লিখতে পারে না। লেখা ত দূরস্ত, উচ্চারণটুকু অব্দি আসেনা, সিলেটিতে অব্দি আসে না, আবার মাঝে মাঝে অন‍্যের অনুকরন করে শুদ্ধ বাংলা লিখতে গিয়ে যা লেখে তা পড়তেও লজ্জা বোধ হয় বাঙালি হিসাবে। পারে যে না তার উপলব্ধি বা লজ্জাটুকুও নেই।

কিন্তু, আরবি, হিন্দি, অসমীয়াটা বেশ আসে, অন্ততঃ মাতৃভাষা বাংলার থেকে তো ভালই আসে। আর ইংরেজিতে তো অক্সফোর্ড।

তাই উনিশে মে নিয়ে এরা শিক্ষা ও চেতনাশূণ‍্য। বরাকের ভাষা শহীদরা তাদের বিচারে বাঙালির আগে হিন্দু।

তারাই তো, বরাকের বাংলা উপর আঘাত হানতে অসমীয়াদের হাত শক্ত করবে! ধর্মান্ধতার স্বার্থে এরা যদি দেশদ্রোহী বিরোধী আইনের বিরোধীতা করতে পারে, আতঙ্কবাদ সমর্থক রাজনৈতিক দল ও দলনেতাদের আদর্শ মানতে পারে, তাহলে মাতৃভাষা আর 'মা' ডাক কে ও বেচতে পারে। বিবেকহীন মানুষ অন্ধকারাচ্ছন্ন থাকে। থাকবেই।
আর এদের সমর্থক আবার বরাকেরই বাঙালী কবি সাহিত‍্যিকরা!
হেসে বাঁচিনে!

বলার উদ্দেশ্য একটাই যে, এখনো যদি আমরা বরাকের বাঙালিরা নিজেদের ধর্ম, রাজনৈতিক স্বার্থ ভুলে শুধুমাত্র বাঙালি হিসাবে ঐক্যবদ্ধ না হতে পারি, তাহলে মিথ্যে হয়ে যাবে বরাকের বাংলা ভাষাশহীদদের রক্তক্ষয়ী আত্মবলিদান।

আজ যদি আমরা নিজেদের নিকৃষ্ট স্বার্থ বাংলা ভাষার শত্রুদের সঙ্গে হাত মিলাই সেই দিন দূর নয় যেদিন CAA এর জন্যে নয়, ভাষা ও আঞ্চলিকতার বিদ্বেষের জন‍্যে বরাক উপত‍্যকার সমগ্র বাঙালি গোষ্ঠীর অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে উঠবে, ধর্ম ও রাজনৈতিক পক্ষাপক্ষ নির্বিশেষে। কারণ, মাতৃভাষা একটি জাতির 
অস্তিত্বের প্রথম সোপান।

সবশেষে একটা কথাই বলব, যে আমি আমার জন্মদায়িনী মায়ের কাছে সীমাতীত কৃতজ্ঞ যে, মা আমাকে বাংলা কে ভালবাসতে শিখিয়েছিলেন, ১৯শে মে এর দুপুরে বরাকের বীর ভাষাশহীদদের সম্মানে এগারোবার যে কামান দাগা হয়, সেটা শুনতে শিখিয়েছিলেন। মাতৃভাষা বাংলার জন্যে কিছু করতে না পারলেও প্রতি বছর এই বিশেষ দিনে সেটাই শোনোর জন‍্যে কান পেতে রই আজো। আর শোনামাত্র বুকের ভিতর কিছু একটা গুমরে মরে আজো। 

যদিও এবার শুনলাম না। দুপুর গড়িয়ে গেল।

উনিশে মে র বরাকের বাংলা ভাষা শহীদদের প্রণাম জানাই। 🙏



No comments:

Post a Comment