Friday 12 July 2013

দায়

কাল শিলচরে আসছে অনুপম রায়।
...আরে বাবা , সেই "আমাকে আমার মত থাকতে দাও".....সেই অনুপম রায়। হ্যাঁ, তুই ঠিকই ধরেছিস,তার আসা নিয়ে আমি এক্সাইটেড নই। তবে খুব মুশকিলে পড়ে গেলাম জানিস তো...! কাল আসবে আর দুটো দিন আমার মাথা শেষ .... দিন মাটি .. কাজ পন্ড!

আবার ভাবছিস, এ কেমন কথা !! আসলে কি হয়েছে বলতো ?..আজ থেকেই শুরু হয়ে গেছে ঢাক পেটানো..ওই টিকেট ফিকেট জোটানোর জন্য । অটোতে বসে ওই পাটকাঠির মতো লোকটা দৈবানুকূল্যে পাওয়া তার পালোয়ানী গলাটা নিয়ে সমানে চেঁচাচ্ছে, " কাল আসছেন ...."..এইসব আর কি!

নাহ্, ওই পাটকাঠির গরজানোতে আমার কিছু যায় আসে না। কিন্তু , বাদ সাধছে, আমাকে আমার মতো ... ঘোষণার মাঝে মাঝে এটাকে ও টুক করে ঢুকিয়ে দিচ্ছে না? যত্তোসব !...গা পিত্তি জ্বলে গেলো এক্কেবারে....!!! আররেহ্, এই গানটা কেমন যেন বেসুরো লাগে আমার ....জানি , তুই তেড়ে মারতে আসবি..তুই কেন হয়তো অনেকেই ...
কিন্তু কি করবো , যেটা সত্যি সেটা সত্যি । বেশ চেপেচুপে ছিলাম এ' কটা দিন,...এবার মনে হচ্ছে ছিঁড়ে যাবে মাথার শিরা!
গানটা শুনলেই মাথাটা দপদপ্ করছে ...একঘেয়ে ...আরো একঘেয়ে...অভিজ্ঞতা একে শোনার । মনে হচ্ছে মাটি খুঁড়ে বেরিয়ে আসছে সেই মৃত সময়ের ছায়া।
তোকে ডাকতে যেতাম যখন ..তুই আমাকে ডেকে সাড়া না পেলে নিজেই যেতাম তোকে ডাকতে ..না হলেই জুটত জমিয়ে গালি। খুব রেগে যেতিস্ তুই , "এত ডাকি, থাকো কোথায় !!?? ..." কখনো নিজেই ডাকতাম কাজে বা অকাজেও, কারণ জানতাম না তুই যতটা ডাকবি ততটা ডাকা যাবে না তোরে! ........ কখনো ঘুমনোর আগে বলতিস ডাকতে ..মুঠোফোনের মুঠো ফাঁকা ..তবু বাধ্যতামূলক তোকে ডাকা ..আবার কখনো ঘুম ভাঙিয়ে দেবার জন্য ....যাতে সকালে অফিসের দেরী না হয়। ডাকতাম তোকে ...ডাকতে হতো ... তুই চাইতিস্ বলে .. আমি চাইতাম বলে ... আর ডাকতে গিয়েই অনুপম রায়, কাবাব মে হাড্ডি ! আমাকে আমার মতো ....বাজছে তো বাজছে...বাজছে তো বাজছেই! অসহ্য লাগতো !

তুই ঘুমোলে নেই ...! আর এদিকে এ বলেই চলেছে এক কথা ....একদিকে বিরক্তিকর অথচ তুই ছিলি এমন একটি মানুষ অন্তত আমার কাছে যার জন্যে বোধহয় অনন্তকাল অপেক্ষা করার সব বিরক্তিও সাধারণ মনে হতো আমার কাছে । তাই রোজ রোজ হাজারবার শুনতে শুনতে কখন যেন ঘোর লেগে যেতো , ভাল না লাগতে লাগতেও ডুবে যেতাম গানটাতে.....

এমনি হয়, অন্যদের জানি না,তবে আমার তো হয়। কেউ কেউ যখন খুব করে তার শাসনে নেয় আমার মনটা, তখন তার নিজের শহর, তার ভালো লাগার সব ছোট বড়ো বিষয় ও আরো অনেক অনেক অনুভূতি বা গান তার থাকাটাকে আরো গভীর করে তোলে আমার কাছে । আমি হয়তো বোকা ...আজকের দিনে অচল পয়সা। এইসব আঁতলামো শুনে ঢি ঢি দেবে লোকে; আর কি!!?? বলবে নেকা!

তবে সে যে যাই বলুক, আমি সেটাই বলছি যেটা আমার একান্ত একার অনুভূতি । তোকে ডাকতে গিয়ে এই গানটা শোনার সময় খালি কেমন একটা মনে হত। মনে হতো প্রথম দিন থেকেই যে, কত স্মৃতি জমা হচ্ছে মনটায়। সবসময় তোর যে পালাই পালাই ভাব সেটা বেশ ধরা পড়তো তোরই বেছে নেওয়া এই গানে। যখনই ডাকতাম তোর ঘুম ভাঙতো না সহজে। গানটা বেজেই চলতো, খালি মনে হতো এই গানটা তোর মনের কথা....আমায় শোনাচ্ছিস্!... আসলে তোর মনের সন্দেহটা আমি বুঝতে পারতাম, আর এটাও জানতাম তুই রঙীন প্রজাপতি । বরং তুই ই বুঝিসনি আমায় । আজও বুঝিসনা, বুঝবিও না কোনদিন , তার প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়েছে আমার কাছে , অনেক আগেই। তবে এটা তুই জানিস যে তোর সেই ঘুম না ভাঙা আর আজকের এই ঘুম না ভাঙা সম্পূর্ণ আলাদা। কারণ , আজ তুই ইচ্ছে করে জোর করে ঘুমিয়ে আছিস্। আসলে মানুষ নিজেকে দিয়েই দুনিয়াকে বিচার করে। আর তাই , কেউ ঠিক ভেবে ঘৃণা করে আর কেউ ভুল বুঝে ভালোবাসে । আদিম প্রবৃত্তির তাড়নায় , কৃত্রিম পরিমন্ডলে বড় হওয়া মানুষ বিশ্বাস করতে চায় না পারে না যে, পাওয়ার লোভ ছাড়াও স্বার্থ ছাড়াও কেউ কাউকে করে তোলে ভীষন দামী তার নিজের কাছে । তবে এটাও ঠিক যে, তুমি দামী ভাবছ যে জিনিস বা যাকে তার প্রতি তোমার লোভ যে নেই সেটাই বা আজকের স্বার্থান্ধ সংকীর্ণমনা দুনিয়া মানবে কেন ?...যেখানে মা ও নিজের সন্তানদের ভালবাসে তাদের মাইনে দেখে...!

তবু বলবো, নেহাত ভুল চরম বোকামি ছিলো যে,আমি বলতে গেছিলাম কোনটা আমার কাছে কতটা দামী ! অন্ধবিশ্বাসে অত গূঢ় নিখাদ কথাটা না বললেই বোধহয় ..... সে থাক্! যাগগে সেসব কথা ।

...সেই কথা ..সেই দিন...
আজ শুধু অতীতের ঋণ; ...
নেই আর কোন খবরে...
উৎসব শেষে বিদায় ভাসান,
স্মৃতিরা নীল বিষাদে পাষাণ
শুয়ে আছে আজ কবরে....!!!

তবে আজ কেন উঠে আসছে তারা কবর খুঁড়ে? অসহ্য ..!..!!!

মনে আছে তোর সেই রাতচরা পাখিটার কথা ? বলেছিলাম তোকে যেখানে বিশাল মাঠের প্রান্তরে সেই নাম না জানা প্রকান্ড গাছটার উপর জাদুকুঠুরীর ছোট্ট জানালা দিয়ে ডাইনীর বন্দিনী মেয়েটি নামিয়ে দিত তার সুদীর্ঘ্য সোনালী চুল , মনে পড়ে ? মড়া চাঁদের আলোয় ভিজে চরাচর জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে মেয়েটির আশঙ্কা ... আশঙ্কা প্রতীক্ষা অন্তহীন হওয়ার । তারারা চোখ টিপে দেখে রাতকে। ..অন্তহীন প্রতীক্ষা আর রাতচরার একটানা ...টি ...টি..টি...টি..ডাক ....ডুবিয়ে দিচ্ছে প্রান্তর ...আবারো ... টি...টি...টি..! ওহ্ মাথার শিরা ছিঁড়ে যাবার জোগাড় !! মনে পড়ে... তোকেই বলেছিলাম ..প্রথম বলেছিলাম তোকে সেই রাতের কথা ?? ...

আজ সেই রাত ...এই রাত ফিরে ফিরে আসে বারবার ....জানিনা কেন ...! ..

রাত বেড়েই চলে ঋজু,..তুই শুনতে পাসনি কখনও , আমি শুনতে পাই সেই পাখির একটানা ডাক , রাতের নিঃস্তব্ধতাকে খানখান করে দিয়ে আর তার ডানার ঝটফটানি! আর.....আর সেই অন্তহীন প্রতীক্ষায় বসে থাকা মেয়েটির ধমনীর সশব্দ নীরব চলা......লাব্...ডুব্....লাব্... ডুব্.....লাবডুব্....!

আমি শুনতে পাই...কিন্তু আমিই কেন ?শুধু আমিই কেন !! কেন মুছে ফেললেও অস্পষ্ট ছবির অস্তিত্ব জেগে থাকে ছায়াপটে? কেন তুই মানে একটি বিশেষ শহরের বৃষ্টিভেজা রাস্তা ..তুই মানে কিছু বিশেষ মূহুর্ত..কুয়াশা ভেজা চাঁদের আলোর রাত্রির শেষ প্রহর! তুই মানে কিছু বিশেষ গান,কেন তুই মানে "আমাকে আমার মতো থাকতে দাও ".....কেন...কেন...কেন? তাহলে আমি কেন থাকতে পারিনি..পারিনা নিজেকে রাখতে আমার মতো! যার বেঁচে থাকাটাই বিলাসিতা !! জীবনের যাঁতাকল আর মানুষের ছল যাকে প্রতিপলে পিষে মারছে ঘরে-বাইরে , আপন-পরে বারবার, তার এই স্মৃতিবিলাস মানায় না, বল? তবুও তুই মানে কিছু কথা ..কিছু ছন্দ ...তুই মানে নয় সেই তীব্র কশাঘাত !...নয় সেই কোমল হৃদয়ের মুখ আর অকৃত্রিম বিশ্বাসের চামড়া ফেটে বেয়ে চলা রক্তের স্রোত ...!বন্ধুত্ব শব্দের চরম উপহাস আর অনায়াস নিলামী।

...সেইভাবে রাখিনি তোকে মনে... হয়তো রাখতে চাইনি বলে মনে ধরে রাখতে এই রূপ তোর, যাকে বিশ্বাস করতাম , অমূল্য স্বপ্নের প্রতিরূপ বলে । করিনি বিচার তোকে তোর মতন করে , রাখতে পারিওনি তোকে তোর মতন করে ..তাই , আজ থাকছিস্ তুই তোর মতন করে..... শুধু মাঝে মাঝে আটকানো যায় না কিছু অনিবার্য্য পরিস্থিতিকে, অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে কিছু মৃত সময়ের ফিরে আসা, যেমন আজ উঠে এলো অনুপম রায়ের হাত ধরে ! অবাক কান্ড !...তাই না ?আজকের পরে, হয়তো বহুদিন পরে...বা, তারও পরে মনে পড়বে তোর বলা সেইসবব্ কথা...তোর খুশি, তোর ঝগড়া..মাঝরাতে আমার ঘুম ভাঙিয়ে.... তোর ডাকে জেগে ওঠা, কবিতার টানে... তোর টানে... কিছু সুর কিছু কথা কিছু গান, দিনরাতের কিছু বিশেষ প্রহর আর ঋতুর বদল, যারা বারবার তোকে এনে দাঁড় করাবে আমার সামনে।

সেই শহরের কথা ভাবলেই ভাসবে তোর মুখ.. ..জানলা দিয়ে দুপুরে যখন আকাশে মাছরাঙাটা যায় মেঘ কেটে কেটে, মন ভাবে ও নাববে তোরই দেশে গিয়ে। তুই রইলি জড়িয়ে কিছু অফুরন্ত অনুভূতিতে.... আমার একান্ত অনিচ্ছায়, তবু বিশাল গভীরতায়........ পারিনি ...পারিনি আমি তোর মতো হতে.তোদের মতো হতে ..নিজের ইচ্ছেমত। সবকিছুই খুবলে নিতে ..... নিজের ভাবনায় মশগুল হতে। তবু , নিজেরই তো ভাবনা।

ভাবনাগুলো এলো চুলে উড়ছে দেখ---- ...আজ সামলানো দায়,

তুই ,

আজ সীমাহীনের বৃত্তে;
নিয়ে গেছিস্ অনেক গান সাথে করে ;
তখনকার,
দুজনেরই প্রিয়, দুজনেই গাইতাম!
তারা আজ পারছে না আর ফিরতে ;
হাওয়ারা শুকনো পাতা করছে জড়ো,
পড়ে আছে কিছু সময়ের গুড়ো!

যখন তুই আসতি.....

জীর্ণ সময় এরা,
হয়না তাদের ফেরা....

"তবু বারবার তোকে ডাক দেই,
...এ কি উপহার, নাকি.... শাস্তি ...!!????"

(Shesh duti line amar noy, eta pathok e bolar projon nei bodhoy!)

No comments:

Post a Comment